প্রতিবন্ধিতার কারণ ও প্রতিকার সময়ের প্রয়োজনে মানুষকে প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে জানতে হচ্ছে। কারণ সমাজের যে ক্ষুদ্র অংশ প্রতিবন্ধী তাদের বাদ দিয়ে বা অবহেলা করে সমাজে উন্নতি করা সম্ভব নয়। এক সময় বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের পাগল বলে হিসেবের বাইরে রাখা হতো। চিকিত্সা, শিক্ষা ও সুরক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হতো। তার প্রতিবন্ধিতা যাতে অন্যদের কাছে প্রকাশ না পায় তার জন্য তাকে বাইরের পরিবেশ থেকে আলাদা করে ঘরবন্দি রাখা হতো। আর সে কারণে প্রতিবন্ধী শিশুটি আরো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বেড়ে উঠতো। তাদের কখনও পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার দেওয়া হতো না। সমাজে নারী প্রতিবন্ধীদের অবস্থা আরো খারাপ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। আমার এক বান্ধবীর বাচ্চা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। ওকে দেখে আমার প্রতিবন্ধীদের বিষয় জানতে আগ্রহ জন্মায়। তার ফলশ্রুতিতে আমি অনেক বই পড়ি এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলি। আমাদের পরিবারে এমন কিছু শিশু দেখা যায় যাদের শারীরিক গঠন স্বাভাবিক নয়, হাত বা পা নেই, কানে শোনে না, ফলে কথাও বলতে পারে না। অনেকে চোখে দেখে না বা কম দেখে। অনেকের বুদ্ধিমত্তা কম, ফলে সামাজিক আচরণ ও ভাব বিনিময়ে সৌজন্যতা বুঝতে পারে না। এরাই আমাদের প্রতিবন্ধী শিশু। এ সকল জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুরা আমাদের সন্তান। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে শিশুরা প্রতিবন্ধী কেন হয়? বিভিন্ন কারণে শিশু প্রতিবন্ধী হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জন্মের পূর্ববালীন কারণ-যেমন মায়ের কিছু নির্দিষ্ট রোগের কারণে শিশু প্রতিবন্ধী হতে পারে। মায়ের যদি জার্মানহাম, চিকেনপক্স, মাম্পস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, রুবেলা ভাইরাস, এইডস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয় এবং সে সময় যদি তিনি গর্ভাবস্থায় থাকেন, তবে এর প্রভাবে শিশুর ক্ষতি হতে পারে। এছাড়াও মায়ের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনির সমস্যা, থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা, মায়ের অপুষ্টি শিশুকে প্রতিবন্ধী করতে পারে। আমাদের মতো গরিব দেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা বেশি। গর্ভাবস্থায় মা যদি চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খায়, তাহলেও অনেক ওষুধের কারণে ভ্রূণের অঙ্গ সৃষ্টিতে বাধার সৃষ্টি হতে পারে, ফলে শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মায়ের বয়স যদি কম হয় তাহলেও শিশু প্রতিবন্ধী হতে পারে। আবার বেশি বয়স করে অর্থাত্ ৩৫ বছরের পর কোনো মহিলা মা হলে তার প্রতিবন্ধী শিশু জন্মগ্রহণ করার ঝুঁকি থাকে। গর্ভাবস্থায় যদি মা ঘনঘন খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত হয় তবে শিশুর অক্সিজেনের অভাব ঘটে ও তার মস্তিষ্কের ক্ষতি করে, ফলে শিশু মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মায়ের শরীরে তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রবেশ হলে অথবা বাবা মায়ের রক্তে Rh উপাদান থাকলে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হবে। আবার আমাদের মতো দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীর অভাব এবং শিশু জন্মের সময় বেশি হলে বা জন্মের সময় মস্তিষ্কে কোনো আঘাত পেলেও শিশু প্রতিবন্ধী হতে পারে। নবজাতক যদি জন্ডিসে আক্রান্ত হয়, শৈশবে যদি হঠাত্ করে পড়ে যায়, পরিবেশে বিষাক্ত পদার্থ থাকলে ও পুষ্টিকর উপাদানের ঘাটতি হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয়। একটু সচেতন হলে, শিশুর জন্মের পরই যদি প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত করা যায় তবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কিছু প্রতিবন্ধিতা থেকে শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব। আমার এক পরিচিত ভদ্রমহিলার সন্তান জন্মগ্রহণের পর পরই বুঝতে পারলেন তার সন্তানের পা বাঁকানো। ভদ্রমহিলা সচেতন হবার কারণে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নেন। ডাক্তার তাকে কিছু ব্যায়াম শিখিয়ে দেন, ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে ‘ম্যানুপুলেশন’। বাচ্চাটির বয়স এখন এক বছর। সে এখন সুন্দর করে হাঁটতে পারে। যদি দেরি হয়ে যেত তবে হয়তো পা দুটি আর ভালো হতো না বা শল্য চিকিত্সার প্রয়োজন হতো যা কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। হয়তো সেটা ওই পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব হতো না এবং শিশুটি প্রতিবন্ধী থেকে যেতো। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্মের পর চোখ দেখেই বোঝা যায়। আবার কিছু কিছু শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পায়। ঠোঁট কাটা, তালু কাটা, মুগুর পা এসব সমস্যা এখন কোনো জটিল সমস্যা নয়। অনেক হাসপাতালে বিনামূল্যে এর চিকিত্সা বা অপারেশন করা হয়। স্পাইনা বিফিট-মেরুদণ্ডের হাড় ঠিকমতো জোড়া লাগে না ফলে হাঁটাচলার সমস্যা হয়। সেরেব্রাল পলসি-শিশু শিথিল বা নেতানোর মতো মনে হয়। আবার কিছু কিছু শিশু জন্মের পর দেখা যায় কোনো কোনো অঙ্গের অনুপস্থিতি বা গঠন বিকৃতি। বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার কোনো চিকিত্সা নেই। তবে যত্নে ও শিক্ষণের মাধ্যমে অনেক শিশুর আচরণের উন্নয়ন ঘটানো যায়। বাংলাদেশে দৃষ্টি, শ্রবণ ও প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জন্ম নেবার পর যদি এদের শনাক্ত করা যায় তবে পিতামাতা একটু সচেতন হলেই ওদের অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জীবন যাপনের উপযোগী করে তুলতে পারে। প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করতে হলে জানতে হবে কেন প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেয় এবং তা রোধ করতে হবে। নারী বেশি বয়সে মা হলে প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মের আশঙ্কা বাড়ে। নারী যতো বেশি বয়সে মা হবেন তার সন্তানের ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মের আশঙ্কা ততো বেশি হবে। ২৫ বছর বয়সী প্রতি ১২০০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজন, ৩০ বছর বয়সী প্রতি ৯০০ জনের মধ্যে একজন আর ৪০ বছর বয়সী প্রতি ১০০ জন মায়ের মধ্যে একজন ডাউন শিশু জন্ম হতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, বাবা-মায়ের কাছ থেকে ক্রোমোজম পেয়ে মানব শিশু তৈরি হয়। সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটলে জন্ম হতে পারে ডাউন শিশু। প্রতিবন্ধিতা রোধ করতে হলে গর্ভকালীন সময় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। ওষুধ গ্রহণে সতর্কতা থাকতে হবে। প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করতে হবে এবং জন্মের পর শিশুদের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুকে লালন-পালন করতে হবে। বেশি বয়সে সন্তান ধারণ রোধ করতে হবে। প্রতিবন্ধী নারীর অধিকার, চলাচল ও প্রবেশগম্যতার অধিকার, কাজের অধিকার, স্বাস্থ্য সেবার অধিকার, সংগঠিত হওয়ার ও স্বাধীনতার অধিকার, স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোতে (ইউপি) অংশগ্রহণ ও সরকারি সেবা প্রাপ্তির অধিকার শিশু অধিকার খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার, আদিবাসী প্রতিবন্ধীদের মানুষের অধিকার, দুর্যোগ থেকে সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। পঞ্চাশোর্ধ্ব বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মারিয়া মন্তেসরি নিশ্চিত হয়ে তার বই ‘দি অ্যাবজরবেন্ট মাইন্ড’ এ লিখেছিলেন—‘মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের ক্ষেত্রে সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত থাকে জীবনের প্রথম ছয় বছরে।’ তাই আজকের প্রতিটি শিশু বা প্রতিবন্ধী শিশু তাদের বিশেষ মনের সুষ্ঠুতম পরিচর্যার দিকে সকল পরিবারের বা সমাজের গভীর দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রতিবন্ধিতা কী, জানতে হবে। অন্যকে জানতে হবে। এ দেশের দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ হচ্ছে প্রতিবন্ধী। তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল সৃষ্টি, বিশেষ শিক্ষা উপকরণ প্রদান, জনগণকে সচেতন ও উদ্ধুদ্ধকরণে সহায়তা প্রদান করা গেলেই এ সমস্যার কিছু সমাধান মিলবে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য যে কোটা সংরক্ষিত আছে তা আরো বাড়াতে হবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য যে বিদ্যালয় রয়েছে তা যথেষ্ট নয়, আরো বিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন।